‘শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশসহ সেমিনার অনুষ্ঠিত

‘শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশসহ সেমিনার অনুষ্ঠিত

23 Jul, 2025 10:00 AM - 23 Jul, 2025 01:00 PM |

‘শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব’
শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশসহ সেমিনার অনুষ্ঠিত
পথ শিশুদের মধ্যে ১০০ শতাংশ শিশুই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে
শৈশবের নিরাপদ ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ মানুষের সারাজীবনের স্বাস্থ্য, মানসিক স্থিতি এবং সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেয়
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশসহ একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারের বিষয় ছিল শৈশবকালীন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুরা (Vulnerability in Childhood and Vulnerable Children)। আজ বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫ইং তারিখে বিএমইউতে বেসিক সাইন্স ভবনের ৯ম তলায় পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় ভাইস চ্যান্সলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম। দি ওপেন ইউনিভার্সিটি (ইউকে), ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ সোস্যাল ওয়ার্ক (ইউএসএ) এবং গ্লোবাল স্ট্রিট কানেক্ট এর সহায়তায় আয়োজিত এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার।
সেমিনারে কীনোট স্পিচ প্রদান করেন পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুল হক। তিনি তার বক্তব্যে পাবলিক এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ভালনারেবিলিটি ইন চিলড্রেন বিশেষ করে ‘শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুল হক জানান, বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য ও ইনফরম্যাটিক্স বিভাগের শ্রেণিকক্ষে শৈশবকালীন প্রতিকূল অভিজ্ঞতা (Adverse Childhood Experiences– ACEs) এবং পরবর্তীকালে দীর্ঘমেয়াদী অসংক্রামক রোগ (Non-Communicable Diseases – NCDs) ও সামাজিক সমস্যার উপর এর প্রভাব নিয়ে পরিচালিত গবেষণাগুলোতে মোট ২৯৭০ জন অংশগ্রহণকারী অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, শৈশবে যারা মানসিক, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বা অবহেলা, পারিবারিক অশান্তি, মাদকাসক্ত পরিবেশ, মা-বাবার বিচ্ছেদ বা পরিবারের কারো কারাবাসের মতো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের জীবনের পরবর্তী সময়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক জটিলতা অনেক বেশি। এই ধরনের শৈশবকালীন প্রতিকূল অভিজ্ঞতার প্রভাব শুধু শারীরিক নয়, মানসিক এবং সামাজিক জীবনেও গভীরভাবে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ACE স্কোর ৪ বা তার বেশি, তাদের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণের তুলনায় দুই গুণ বেশি। একইভাবে, যেসব মায়েদের জীবনে তিনটির বেশি ACE ছিল, তারা নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার (NDD)-এ আক্রান্ত সন্তানের জন্ম দেওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন চার গুণ বেশি। হৃদরোগ (Ischemic Heart Disease) হওয়ার সম্ভাবনাও অঈঊ এর সংখ্যা অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। যারা শৈশবে অঈঊ-র অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তাদের মধ্যে বিষণœতা, উদ্বেগ ও স্ট্রেসের মাত্রা অনেক বেশি দেখা গেছে, যা একটি শক্তিশালী সম্পর্ক নির্দেশ করে। এছাড়া, শৈশবে ACE -র অভিজ্ঞতা থাকলে পরবর্তীকালে দাম্পত্য সহিংসতার (Intimate Partner Violence) ঝুঁকি বেড়ে যায়। বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্ভাবনাও ACE থাকার ফলে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ACE -এর একটি সম্পর্ক থাকলেও তা পরিসংখ্যানগতভাবে খুব শক্তিশালী প্রমাণিত হয়নি। তবে অর্থনৈতিক নির্যাতনের মতো বিষয়েও অঈঊ-এর প্রভাব পাওয়া গেছে, যদিও সেটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিল। এই গবেষণাগুলোর সবচেয়ে বড় বার্তা হলো—শৈশবের নিরাপদ ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ শুধু তাৎক্ষণিক কল্যাণ নয়, বরং একজন মানুষের সারাজীবনের স্বাস্থ্য, মানসিক স্থিতি এবং সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেয়। একটি শিশুর জীবনে ভালোবাসা, নিরাপত্তা এবং যতেœর অভাব হলে তা তার ভবিষ্যৎ জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই সমাজের সকল পর্যায়ে পরিবার, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে—শৈশবে সহিংসতা ও অবহেলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসান রেজা গ্লোবাল স্ট্রিট কানেক্ট পরিচালিত একটি ন্যাশন ওয়াইড মিক্সড-মেথডস স্ট্যাডিস এর ফলাফল উপস্থাপন করেন যেখানে বাংলাদেশের স্ট্রিট কানেক্টেড বা পথ শিশুদের উপর নির্যাতনের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়। গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়, এ ধরণের শিশুদের মধ্যে ১০০ শতাংশ শিশুই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রায় সকলেই অর্থনৈতিক শোষণের মুখোমুখি হয়েছে। ২৭ শতাংশ শিশু জানে না তাদের পিতা-মাতার অবস্থান সম্পর্কে। ৯৭ শতাংশ শিশু এসেছে অত্যন্ত নি¤œ আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে। ড. হাসান রেজা এ প্রসঙ্গে বলেন, এই শিশুদের প্রতিদিনের জীবনে যে পরিমাণ ট্রমা ঘটে, তা শুধু তাদের শৈশব নয়, ভবিষ্যত জীবনেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। সময়মতো সহায়তা না পেলে, মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি ভয়াবহ হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের দি ওপেন ইউনিভার্সিটির মেন্টাল হেলথ ক্লিনিশিয়ান ও ফ্যাকাল্টি মেম্বার ডা. শরীফ হায়দার বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য কোনো গৌণ বিষয় নয় এটাই শিশু সুরক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। গবেষণা বলছে, একটি শিশুর জীবনে যত বেশি এডভারস চাইল্ডহুড এক্সপ্রিয়েন্সেস ঘটে, তার মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও তত বেশি। সহিংসতা প্রতিটি শিশুর মনে অদৃশ্য দাগ রেখে যায়, যা সারাজীবন বহন করে বেড়াতে হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় ভাইস চ্যান্সলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, শৈশবকালের প্রতিকূলতা ও তার স্বাস্থ্যগত প্রভাবসহ এধরণের গবেষণা ও নানামুখী কার্যক্রম তাদের সু-স্বাস্থ্যসহ নিশ্চিত করা, সুরক্ষাসহ সুন্দর ভবিষ্যত জীবন নিশ্চয়তায় বিরাট ভূমিকা রাখবে। শিশুরা যাতে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্র সহিংসতা, অবহেলা ও অত্যাচারের শিকার না হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। শৈশব থেকেই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ থাকলে ভবিষ্যতে তাদের স্বাস্থ্যের উপর নানা ধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা গবেষণায় প্রমাণিত।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মোঃ মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, পুরুষ শাসিত সমাজে নারী স্বাস্থ্য অবহেলিত। কন্যা শিশুরা সবচাইতে বেশি অবহেলা, অত্যাচারে নির্যাতনের শিকার হয়। পরিবার, সমাজ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নানা ধরণের অত্যাচার নির্যাতন ও মানসিক চাপের শিকার হয়ে ট্রমাসহ অনেক শিশু মানসিক রোগে ভুগছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে এসকল বিষয় নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাগুলি বাস্তবায়ন করতে পারলে শিশুদের ভবিষ্যত সু-স্বাস্থ্য অবশ্যই নিশ্চিত করা যাবে।
সেমিনারে শুরুতে সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিহা হাসিন বলেন, “শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পাবিলক হেলথ পলিসি এবং সোস্যাল জাস্টিস খাতে সমন্বিতভাবে কাজ করতেই হবে।
সেমিনারের শেষাংশে বক্তারা এবং অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশের স্ট্রিট কানেক্টেড শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমুখী কর্মপন্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। এই সেমিনারটি ছিল গ্লোবাল স্ট্রিট কানেক্ট পরিচালিত জাতীয় পর্যায়ের প্রচারণা ব্রেক দ্যা সাইকেল-স্টপ ভায়োলেন্স এ্যাগেইনস্ট স্ট্রিট চিলড্রেন (Break the Cycle – Stop Violence Against Street Children) এর অংশ, যার উদ্দেশ্য হলো শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নীতিনির্ধারণে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা।
সম্পাদনায়: ডা. সাইফুল আজম রঞ্জু। ছবি: মোঃ আরিফ খান। নিউজ: প্রশান্ত মজুমদার।