বিএমইউতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে  গবেষণার ফলাফল প্রকাশ

বিএমইউতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ

07 Aug, 2025 10:00 AM - 07 Aug, 2025 01:00 PM |

বিএমইউতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে ৩টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী মায়েদের গর্ভকালে ৬৪টি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়
বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএমইউ) বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের স্বাস্থ্য চিন্তা নিয়ে ৩টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। আজ ৭ আগস্ট ২০২৫ইং তারিখে বিএমইউ এর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের কনফারেন্স রুম-৫০৪ এ আয়োজিত এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম। পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ আয়োজিত গবেষণার বিষয় ছিল কমিউনিটি পর্যায়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসমূহের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ, পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ-সংশ্লিষ্ট আচরণ এবং খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী মহিলাদের ফুড ট্যাবু। গবেষণায় জানানো হয়, ত্রিপুরা, চাকমা এবং মারমাদের মধ্যে ৬৪টি খাবার পাওয়া গেছে যা গর্ভকালে খাওয়া থেকে গর্ভবতী মায়েদের বিরত থাকতে বলা হয়, অথচ এই খাবারগুলোর মধ্যে প্রায় সকল খাবারই মা ও মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর জন্য পুষ্টিকর। তাই প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার দূর করে মা ও অনাগত নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই খাবারগুলো খেতে বেশি করে উৎসাহিত করা উচিত।
অনুষ্ঠানে মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মোঃ শাহিনুল আলম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে গণআকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছে তার গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন আন্তর্জাতিক মানের উচ্চতর মেডিক্যাল শিক্ষা প্রদান, সর্বাধুনিক চিকিৎসাসেবা প্রদান ও গবেষণা কার্যক্রম জোরদার ও বিস্তৃত করেছে। গবেষণায় মাধ্যমে বিএমইউ আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মানে অবদান রাখবে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএমইউএর কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার বলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী মায়েদের গর্ভকালে যে খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে তা কাম্য নয়। পুষ্টিকর সকল খাবারই খেতে হবে। এ সকল খাবারের কারণে জন্মগত ত্রুটি হয় না তা জোর দিয়ে বলতে হবে। মা ও গর্ভে থাকা শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করতে গর্ভকালে খাবার নিয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সমাজে বিদ্যমান ফুড ট্যাবুকে দূর করতে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে বৈচিত্র্যময় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস, যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচয়। দেশে ৫৪টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর আনুমানিক ১৬ লাখ সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মু, সাঁওতাল, খাসি, গারো, বম, হাজং এবং মণিপুরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতি বছর ৯ই আগস্ট বিশ্বব্যাপী ‘আদিবাসী দিবস’ পালিত হয়। এই দিনের গুরুত্বকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের উদ্যোগে আজকের এই সেমিনার ও গবেষণার ফলাফল প্রকাশের আয়োজন। পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিকুল হকের সভাপতিত্বে ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোঃ খালেকুজ্জামানের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন নিপসম এর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোঃ জিয়াউল ইসলাম। গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন ডা. রাজন তালুকদার, ডা. অনির্বান চাকমা এবং ডা. লাবন্য ত্রিপুরার পরিবর্তে ডা. মোঃ খালেকুজ্জামান।
কমিউনিটি পর্যায়ে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসমূহের ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বিষয়ে প্রধান গবেষক ছিলেন ডা. অনির্বাণ চাকমা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত কাউখালী, নানিয়ারচর ও রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় (রাঙামাটি পৌরসভা ব্যতীত) বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী থেকে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণকারী মোট ২৩৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ সদস্যের মুখোমুখি সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে এই গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী সংগ্রহ করা হয়। এতে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ বিষয়ক জ্ঞান, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের অভ্যাস সম্পর্কে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের যে তথ্য পাওয়া যায় তা তুলে ধরা হয়। প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে যে সুপারিশ করা হয় তা হলো ম্যালেরিয়ার ব্যাপক প্রতিরোধের জন্য ঝুঁকিতে থাকা সম্প্রদায়গুলোকে ম্যালেরিয়ার লক্ষণসমূহ, আবদ্ধ পানি অপসারণের গুরুত্ব, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় এবং নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলা উচিত। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা সময় মত স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে করতে সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধকরণে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ-সংশ্লিষ্ট আচরণ বিষয়ে প্রধান গবেষক ছিলেন ডা. রাজন তালুকদার। সারাবিশ্বে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো অসংক্রামক রোগ। বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মৃত্যুর পেছনে রয়েছে এইসকল অসংক্রামক রোগ। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রবীণরা অন্যদের তুলনায় এই সকল রোগে বেশি ভুগলেও গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যান। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ-সংশ্লিষ্ট আচরণ বিষয়ে জানা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণসংশ্লিষ্ট আচরণ মূলত তিন ধরণের বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বলে গবেণায় জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা বাংলায় যোগাযোগ করেন বলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর প্রবীণরা ভাষাগত বাধার মুখোমুখি হন এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বলে প্রবীণরা সেখানে যেতে চান না। তাই ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা জানা স্থানীয়দেরকে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া, পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীদেরকে উৎসাহিত করা উচিৎ যেন তারা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার সময় প্রবীণদেরকে সঙ্গ দেন এবং স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সেবা পেতে অপেক্ষার সময় কমিয়ে ও ওষুধের মূল্য কমিয়ে আনা ইত্যাদি সুপাপরিশ করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী মহিলাদের ফুড ট্যাবু নিয়ে গবেষণা করেন ডা. লাবন্য ত্রিপুরা। গর্ভাবস্থায় মায়েদের পুষ্টি চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ট্যাবুর কারণে চারপাশে সহজলভ্য পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া থেকে গর্ভবতী মাকে নিরুৎসাহিত করায় মা এবং শিশু বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের জীবনাচরণ, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি ভিন্ন হওয়ার কারণে গর্ভাবস্থায় ফুড ট্যাবুও আলাদা হওয়ার কথা। তাই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর গর্ভবতী মায়েদের ফুড ট্যাবু সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এই বিষয়ে গবেষণা জানা যায় ত্রিপুরা, চাকমা এবং মারমাদের মধ্যে ৬৪টি খাবার পাওয়া গেছে যা গর্ভকালে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। খাবারগুলোর মধ্যে ফল, শাক-সবজি, পশুজাত খাদ্য, মাছ, পানীয় এবং জলখাবার রয়েছে। তাদের ভ্রান্ত ধারণা যে এই খাবারগুলো খেলে গর্ভে থাকা শিশুর ক্ষতি হয়। এই ফুড ট্যাবু সম্পূর্ণই কুসংস্কার এবং মা ও অনাগত নবজাতকের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। গর্ভকালীন ফুড ট্যাবু টিকিয়ে রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখেন গর্ভবতীর মা, শাশুড়ি, ননদ, দাদী-নানী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধাত্রী বা দাইকেও এই ভূমিকা রাখতে দেখা যায়। গর্ভপাত, প্রসবজনিত জটিলতা, রক্তস্বল্পতা, প্রসব পরবর্তী জরায়ুর ঘা-এর মতো মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিশ্বাসও বিশেষ বিশেষ খাবার থেকে বিরত রাখতে উৎসাহিত করে। ৪৬.৬ শতাংশ গর্ভবতীকেই কোনো না কোনো খাবার ট্যাবু হিসাবে এড়িতে যেতে দেখা গেছে। গবেষণার সুপারিশে বলা হয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গর্ভবতী মহিলাদের মধ্য থেকে ফুড ট্যাবু দূর করার মাধ্যমে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করা উচিৎ। গর্ভাবস্থায় পুষ্টিকর খাদ্য সম্পর্কে ভুল-বিশ্বাস দূর করতে এবং সচেতন করতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি মেনে উপযুক্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি গড়ে তুলতে হবে। সকল ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও জাতিসত্তার জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে আরও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিৎ।
সম্পাদনায়: ডা. সাইফুল আজম রঞ্জু। ছবি: মোঃ আরিফ খান। নিউজ: প্রশান্ত মজুমদার।